হৃদযন্ত্রের যত কথা
অধ্যায়-৩য়
রক্ত (Blood) :
- রক্ত হলো লাল বর্ণের অস্বচ্ছ, ঈষৎ লবণাক্ত, কিছুটা ক্ষারীয় তরল যোজক টিস্যু বা কলা।
- একজন পূর্ণবয়স্ক সুস্থ মানুষের দেহে প্রায় ৫-৬ লিটার রক্ত থাকে। যেটি মানুষের দেহের মোট ওজনের ৮%।
- হিমোগ্লোবিন রক্তকে লাল করে এবং এটি অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে অক্সিহিমোগ্লোবিন তৈরি করে।
রক্তের উপাদান ও কাজ :
- রক্তের প্রধান উপাদানগুলো হলো রক্তরস বা প্লাজমা এবং রক্তকণিকা।
- সমগ্র রক্তের ৫৫% রক্তরস এবং বাকি ৪৫% রক্তকণিকা।
- রক্তরসকে আলাদা করলে এটি হলুদ বর্ণের দেখায়।
রক্তরস বা প্লাজমা :
- রক্তের তরল অংশকে প্লাজমা বলে।
- রক্তরসের প্রায় ৯০% পানি, বাকি ১০% দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। বিভিন্ন রকমের জৈব ও অজৈব পদার্থ সৃষ্টি হয়।
অজৈব পদার্থ : সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ক্লোরিন, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ, আয়োডিন ইত্যাদি খনিজ পদার্থের আয়ন।
জৈব পদার্থ : খাদ্যসার, রেচন পদার্থ, প্রোটিন, প্রতিরক্ষামূলক দ্রব্যাদি, নি:সৃত বিভিন্ন হরমোন, কোলেস্টেরল ইত্যাদি নানা ধরনের যৌগ।
রক্তরসের কাজ:
- রক্তকণিকাসহ রক্তরসে দ্রবীভূত খাদ্যসার দেহের বিভিন্ন অংশে অতিবাহিত করা।
- টিস্যু থেকে বর্জ্য পদার্থ নির্গত করে, সেগুলা রেচনের জন্য বৃক্কে পরিবহন করা।
- রক্ত জমাট বাঁধার প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো পরিবহন করা।
- হরমোন, এনজাইম, লিপিড প্রভৃতি দেহের বিভিন্ন অংশ বহন করা।
- রক্তের অম্ল-ক্ষারের ভারসাম্য রক্ষা করা।
সিরাম: রক্ত জমাট বাঁধার পর যে হালকা হলুদ রংয়ের স্বচ্ছ রস পাওয়া যায়, তাকে সিরাম বলে।
রক্তকণিকা: রক্তরসের মধ্যে ছড়ানো বিভিন্ন রকমের কোষকে রক্তকণিকা বলে। রক্তকণিকা প্রধানত তিন ধরনের। যথা:
(ক) লোহিত রক্তকণিকা (Erythrocyte)
(খ) শ্বেত রক্তকণিকা (Leukocyte)
(গ) অনুচক্রিকা (Thrombocyte)
লোহিত রক্তকণিকা :
- লোহিত রক্তকণিকা দ্বি-অবতল এবং চাকতির মত।
- হিমোগ্লোবিন নামক রঞ্জক পদার্থ থাকে। যা দেখতে লাল বর্ণের।
- একে Red Blood Cell বা RBC বলে।
- এতে হিমোগ্লোবিন ভর্তি চ্যাপ্টা আকৃতির ভাসমান ব্যাগ থাকার কারণে অধিক পরিমাণ অক্সিজেন পরিবহন করতে পারে।
- এই কণিকাগুলো বিভাজন হয় না, যা সবসময় অস্থিমজ্জার ভিতরে উৎপন্ন হতে থাকে এবং উৎপন্ন হওয়ার পর রক্তরসে চলে আসে।
- মানুষের লোহিত রক্তকণিকার আয়ু প্রায় চার মাস অর্থাৎ ১২০ দিন।
- এটি প্লীহা তে সঞ্চিত থাকে এবং তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে প্লীহা থেকে লোহিত কণিকা রক্তরসে সরবরাহ করে।
- ভ্রূণ অবস্থায় দেহে ৮০-৯০ লাখ, শিশুর দেহে: ৬০-৭০ লাখ, পূর্ণবয়স্ক পুরুষ দেহে ৪.৫-৫.৫ লাখ এবং পূর্ণবয়স্ক নারীর দেহে ৪.৫-৫.০ লাখ।
লোহিত রক্তকণিকার কাজ:
- দেহের প্রতিটি কোষে অক্সিজেন সরবরাহ করা।
- নিষ্কাশনের জন্য কিছু পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইডকে টিস্যু থেকে ফুসফুসে বহন করা।
- হিমোগ্লোবিনের সাহায্যে রক্তের অম্ল-ক্ষারের সমতা বজায় রাখার জন্য বাফার হিসেবে কাজ করা।
শ্বেত রক্তকণিকা:
- এটির নির্দিষ্ট কোনো আকার নেই। এগুলো হিমোগ্লোবিনবিহীন এবং নিউক্লিয়াসযুক্ত বড় আকাররের কোষ।
- এর গড় আয়ু ১-১৫ দিন।
- এদের মধ্যে হিমোগ্লোবিন না থাকাতে while Blood Cell বা WBC বলে।
- এরা অ্যামিবার মতো দেহের আকার পরিবর্তন করে।
- এরা ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় জীবাণুকে ধ্বংস করে।
- মানবদেহে প্রতি ঘনমিলিমিটার রক্তে ৪-১০ হাজার শ্বেত রক্তকণিকা থাকে।
- এ কণিকায় DNA অবস্থান করে।
প্রকারভেদ:
শ্বেত রক্তকণিকা | |
অ্যাগ্রানুলোসাইট বা দানাবিহীন | গ্রানুলোসাইট বা দানাযুক্ত |
১. সাইটোপ্লাজম দানহীন ও স্বচ্ছ। ২. এই কণিকায় ২ ধরনের। যথা: লিম্ফোসাইট ও মনোসাইট। ৩. দেহের লিম্ফনোড, টনসিল, প্লীহা অংশে লিম্ফোসাইট তৈরি হয়। ৪. লিম্ফোসাইটগুলো বড় নিউক্লিয়াস যুক্ত ছোট কণিকা। ৫. মনোসাইট ছোট, ডিম্বাকার ও বৃক্কাকার নিউক্লিয়াস বিশিষ্ট বড় কণিকা। ৬. লিম্ফোসাইট অ্যান্টিবডি গঠন করে এবং এই অ্যান্টিবডির দ্বারা দেহে প্রবেশ করা রোগ জীবানু ধ্বংস করে। ৭. মনোসাইট ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় রোগ জীবাণু ধ্বংস করে। | ১. এদের সাইটোপ্লাজম সূক্ষ্ম দানাযুক্ত। ২. এই কণিকা তিন প্রকার। যথা: নিউট্রোফিল, ইত্তসিনোফিল ও বেসোফিল। ৩. নিউট্রোফিল ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় জীবাণু ভক্ষণ করে। ৪. ইত্তসিনোফিল ও বেসোফিল হিস্টামিন নামক রাসায়নিক পদার্থ নি:সৃত করে দেহে এলার্জি প্রতিরোধ করে। ৫. বেসোফিল হেপারিন নি:সৃত করে রক্তকে রক্তবাহিকার ভেতরে জমাট বাঁধা দেয়। |
অনুচক্রিকা বা থ্রম্বোসাইট:
- ইংরেজিতে এদেরকে প্ল্যাটেলেট বলে।
- এগুলো গোলাকার, ডিম্বাকার অথবা রড আকারের হতে পারে।
- এদের সাইটোপ্লাজম দানাদার এবং সাইটোপ্লাজমে কোষ অঙ্গাণু-মাইটোকন্ড্রিয়া, গলগি বস্তু থাকে।
- এরা নিউক্লিয়াসবিহীন।
- এদের গড় আয়ু ৫-১০ দিন।
- মানবদেহে প্রতি ঘনমিলিমিটার রক্তে অণুচক্রিকার সংখ্যা প্রায় ২.৫ লাখ।
অনুচক্রিকার কাজ:
- প্রধান কাজ রক্ত জমাট বাঁধানোতে সাহায্য করা।
- এতে ফাইব্রিন নামক একধরনের অদ্রবনীয় প্রোটিন থাকে যা ক্ষত স্থানে জমাট বাধেঁ এবং রক্তক্ষরণ বন্ধ করে।
- এ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ এবং ভিটামিন K ও ক্যালসিয়াম আয়ন জড়িত থাকে।
রক্তের সাধারণ কাজ:
- শ্বাসকার্য: রক্ত অক্সিজেনকে ফুসফুস থেকে টিস্যু কোষে এবং টিস্যু কোষ থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইডকে ফুসফুসে পরিবহন করে।
- হরমোন পরিবহন: অন্তক্ষরা গ্রন্থি থেকে নি:সৃত হরমোন দেহের বিভিন্ন অংশে পরিবহন করে।
- খাদ্যসার পরিবহন: দেহের সঞ্চয় ভান্ডার তেকে এবং পরিপাকৃত খাদ্যসার দেহের টিস্যু কোষগুলোতে বহন করে।
- বর্জ্য পরিবহন: নাইট্রোজনেঘটিত বর্জ্য পদার্থগুলোকে কিডনি বা বৃক্ক পরিবহন করে।
- উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণ: দেহে তাপের বিস্তৃতি ঘটিয়ে দেহের নির্দিষ্ট তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
- O গ্রুপের রক্তকে বলা হয় ইউনিভার্সাল ডোনার বা সার্বজনীন দাতা।
- AB গ্রুপের রক্তকে বলা হয় ইউনিভার্সাল একসেপ্টের বা গ্রহীতা ।
Rh ফ্যাক্টর: রেসাস নামের বানরের লোহিত রক্তকণিকায় এক ধরনের অ্যান্টিজেন রয়েছে যেটি অনেক মানুষের রক্তের লোহিত কণিকায় পাওয়া যায়। এই নাম অনুসারে এক Rhesus Factor বা Rh ফ্যাক্টর বলে।
রক্ত সঞ্চালন: মানবদেহে রক্ত সংবহন করার সময় যে প্রক্রিয়াতে রক্ত নালীসমূহের মধ্য দিয়ে হৃদপিন্ড থেকে বের হয়ে সমস্ত শরীরে বাহিত হয়ে পুনরায় হৃদপিন্ডে ফিরে আসে তাকে রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া বলে।
হৃদপিন্ড (Heart): দুটি ফুসফুসের মধ্যে এবং ডায়াফ্রাম (মধ্যচ্ছেদ পর্দা) এর উপর থোরাক্সে অবস্থিত। পেরিকার্ডিয়াম নামক ২ স্তর বিশিষ্ট পর্দা দ্বারা আবৃত থাকে। এর আকৃতি কোণের ন্যায় এবং ৪টি প্রকোষ্ঠে বিভক্ত। যথা:
(ক) ডান অলিন্দ (Right Atrium)
(খ) ডান নিলয় (Right Ventricle)
(গ) বাম অলিন্দ (Left Atrium)
(ঘ) বাম নিলয় (Left Ventricle)
ধমনি (Urtary) : যে সব রক্তনালির মাধ্যমে রক্ত হৃৎপিন্ড থেকে দেহের বিভিন্ন অংশে বাহিত হয়, তাকে ধমনি বা আর্টারি বলে। বৈশিষ্ট্য :
- ধমনি প্রাচীর পুরু এবং তিনটি স্তরে গঠিত।
- এদের কোষ গহ্বর ছোট।
- কপাটিকা থাকেনা বলে ধমনি দিয়ে রক্ত বেগে প্রবাহিত হয়।
- এদের স্পন্দন আছে।
শিরা : যেসব রক্তনালির মাধ্যমে কার্বন ডাই-অক্সাইড পূর্ণ রক্ত দেহের বিভিন্ন অঙ্গ থেকে হৃৎপিন্ডে ফিরে আসে, তাদের শিরা বলে। বৈশিষ্ট্য :
- শিরার প্রাচীর ধমনীর প্রাচীরের তুলনায় পাতলা।
- শিরায় শ্বেত যোজক কলা বেশি পরিমান থাকে।
- কপাটিকা থাকায় শিরা দিয়ে রক্ত ধীরে ধীরে একমুখে প্রবাহিত হয়।